মাওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন (১৯৫৭)
মাওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন (১৯৫৭)
মাওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন (১৯৫৭) |
ভূমিকা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সম্মেলন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশে ও স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তি গঠনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। তৎকালীন সময়ে মাওলানা ভাসানী ছিলেন কৃষক, শ্রমিক ও নিপীড়িত মানুষের নেতা। তার নেতৃত্বে কাগমারী সম্মেলন এক নতুন রাজনৈতিক দিগন্তের সূচনা করেছিল।
কাগমারী সম্মেলনের পটভূমি
পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন আন্দোলনে যুক্ত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণীত হলেও এতে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বার্থরক্ষা করা হয়নি। এই পরিস্থিতিতে মাওলানা ভাসানী তৎকালীন আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসে একটি নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেন।
কাগমারী সম্মেলনের সময় ও স্থান
কাগমারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ৭-৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৭ সালে, টাঙ্গাইল জেলার কাগমারীতে। এটি ছিল এক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সমাবেশ যেখানে হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। মাওলানা ভাসানী এই সম্মেলনের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেন এবং জনগণের অধিকারের পক্ষে আওয়াজ তোলেন।
সম্মেলনের মূল বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত
১. পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ: মাওলানা ভাসানী পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য সমানাধিকারের দাবি জানান। 2. ভারত ও চীনের সাথে সুসম্পর্ক গড়ার আহ্বান: তিনি পাকিস্তানের শাসকদের ভারত ও চীনের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার পরামর্শ দেন, যা তৎকালীন পাকিস্তানের জন্য এক ব্যতিক্রমী বক্তব্য ছিল। 3. পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি: তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের ওপর জোর দেন এবং জনগণকে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলনে যোগ দিতে বলেন। 4. আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যাওয়া: মাওলানা ভাসানী কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন এবং তার নতুন রাজনৈতিক পরিকল্পনার ঘোষণা দেন।
কাগমারী সম্মেলনের প্রভাব
এই সম্মেলনের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান মাওলানা ভাসানীকে বিপজ্জনক নেতা হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, কাগমারী সম্মেলনই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেরণা যুগিয়েছিল। মাওলানা ভাসানীর বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত পরবর্তী সময়ে ৬ দফা আন্দোলন এবং শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
উপসংহার
মাওলানা ভাসানীর কাগমারী সম্মেলন শুধু একটি রাজনৈতিক সমাবেশ ছিল না; এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের নিপীড়িত জনগণের অধিকার আদায়ের এক ঐতিহাসিক দলিল। এই সম্মেলন বাংলার জনগণকে একটি নতুন রাজনৈতিক চেতনার দিকে ধাবিত করেছিল, যা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে তুলেছিল।