ইসলামের আলোকে ন্যায়বিচার: একটি পরিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলামের আলোকে ন্যায়বিচার: একটি পরিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি
ন্যায়বিচার মানব সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। একটি সমাজ তখনই শান্তি ও স্থিতিশীলতা লাভ করে যখন সেখানে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলাম ন্যায়বিচারকে শুধু একটি নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ফরজ বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। কুরআন ও হাদিসে ন্যায়বিচারের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
![]() |
ইসলামের আলোকে ন্যায়বিচার: একটি পরিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি |
ন্যায়বিচারের সংজ্ঞা ও তাৎপর্য
ন্যায়বিচার অর্থ হলো প্রত্যেকের প্রাপ্য অধিকার যথাযথভাবে প্রদান করা এবং কারো প্রতি কোনো অবিচার না করা। ইসলামে ন্যায়বিচার শুধু শাস্ত্রীয় বা আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ।
আল্লাহ বলেন,
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَىٰ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়বিচার, সদাচার ও আত্মীয়দের হক আদায়ের নির্দেশ দেন।”
(সুরা আন-নাহল: ৯০)
ইসলামে ন্যায়বিচারের গুরুত্ব
ইসলামে ন্যায়বিচারের গুরুত্ব তুলে ধরতে কয়েকটি বিষয় আলোচনা করা যেতে পারে:
১. আল্লাহ ন্যায়বিচারকে বাধ্যতামূলক করেছেন
ন্যায়বিচার কেবল একটি ভালো গুণ নয়, বরং ইসলামের একটি মৌলিক বিধান। আল্লাহপাক মানুষকে আদেশ করেছেন—
وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوا وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَىٰ
“যখন তোমরা কথা বলবে, তখন ন্যায়বিচারের সাথে বলবে, যদিও সে তোমার আত্মীয় হয়।”
(সুরা আল-আন’আম: ১৫২)
২. নবী (সা.) ছিলেন ন্যায়বিচারের আদর্শ উদাহরণ
রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন ন্যায়বিচারের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। তিনি বলেছেন—
“সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ হলো জালিম শাসকের সামনে ন্যায় কথা বলা।” (তিরমিজি: ২১৭৪)
রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো কারো প্রতি অন্যায় করেননি এবং অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি।
৩. কিয়ামতের দিনে বিচার হবে ন্যায়ের ভিত্তিতে
আল্লাহ বলেন—
وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ
“আমরা কিয়ামতের দিন ন্যায়ের পাল্লা স্থাপন করবো।”
(সুরা আল-আম্বিয়া: ৪৭)
ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে কিছু মূলনীতি
১. সত্যের প্রতি অটল থাকা
ন্যায়বিচারের প্রথম শর্ত হলো সত্যের প্রতি দৃঢ় থাকা। কোনো ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে সত্যকে লুকানো যাবে না।
২. ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে পক্ষপাতিত্ব না করা
কুরআনে বলা হয়েছে—
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَىٰ أَنفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ
“হে ঈমানদারগণ! ন্যায়বিচারের জন্য দাঁড়াও এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সাক্ষ্য দাও, যদিও তা তোমাদের নিজেদের, তোমাদের পিতামাতার বা আত্মীয়দের বিরুদ্ধে যায়।”
(সুরা আন-নিসা: ১৩৫)
৩. ধনী-গরিবের মধ্যে পার্থক্য না করা
ইসলামে ধনী-গরিব, ক্ষমতাবান-দুর্বল সবার জন্য একই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
“তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো ধ্বংস হয়েছে এই কারণে যে, তারা ক্ষমতাবানদের অপরাধ মাফ করে দিত, কিন্তু দুর্বলদের কঠোর শাস্তি দিত।” (বুখারি: ৬৭৮৮)
ইসলামে ন্যায়বিচারের বিভিন্ন ক্ষেত্র
১. পারিবারিক জীবনে ন্যায়বিচার
- স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ন্যায়বিচার
- সন্তানদের মধ্যে বৈষম্য না করা
- উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার
২. সামাজিক ন্যায়বিচার
- ধনী-গরিবের মধ্যে সাম্যতা
- শ্রমিকদের প্রতি সুবিচার
৩. রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার
- শাসকদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বাধ্যবাধকতা
- আদালতে পক্ষপাতহীন বিচার
ন্যায়বিচার লঙ্ঘনের পরিণতি
যে সমাজে ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হয়, সেখানে অরাজকতা, দুর্নীতি ও অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। রাসূল (সা.) বলেছেন—
“যে ব্যক্তি ন্যায়বিচার থেকে সরে যায়, সে কিয়ামতের দিনে আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর সাহস পাবে না।” (তিরমিজি: ১৩৩৭)
উপসংহার
ইসলামে ন্যায়বিচার শুধু একটি সামাজিক নীতি নয়, বরং একটি ধর্মীয় দায়িত্ব। আল্লাহ আমাদের সকলকে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন।