প্লুটো গ্রহ আবিষ্কারের দিন (1930)

 প্লুটো গ্রহের আবিষ্কার: এক রহস্যময় গ্রহের চমকপ্রদ ইতিহাস

প্লুটো গ্রহ আবিষ্কারের দিন (1930)


ভূমিকা

১৮ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৩০—এই দিনটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনেই ক্লাইড টমবাউ (Clyde Tombaugh) প্লুটো গ্রহের অস্তিত্ব শনাক্ত করেন, যা তখন সৌরজগতের নবম গ্রহ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। প্লুটোর আবিষ্কার জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও মহাকাশ গবেষকদের জন্য এক যুগান্তকারী ঘটনা ছিল। যদিও পরবর্তীতে একে 'বামন গ্রহ' হিসেবে পুনঃশ্রেণীবদ্ধ করা হয়, তবুও এর আবিষ্কার ও গবেষণা আজও মহাকাশ বিজ্ঞানের অন্যতম চমকপ্রদ অধ্যায়।


প্লুটোর আবিষ্কারের পটভূমি

১৯ শতকের শেষের দিকে, বিজ্ঞানীরা সৌরজগতের গ্রহগুলোর কক্ষপথ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে বুঝতে পারেন যে নেপচুন ও ইউরেনাসের গতি কিছুটা অস্বাভাবিক। এই অস্বাভাবিকতার পেছনে কোনো অদেখা গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ বল কাজ করছে বলে ধারণা করা হয়। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা একটি নতুন গ্রহের সন্ধানে নামেন।

পার্সিভাল লোয়েল (Percival Lowell) নামের একজন মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ১৯০৬ সালে প্ল্যানেট এক্স (Planet X) নামের এক সম্ভাব্য গ্রহের খোঁজ শুরু করেন। কিন্তু ১৯১৬ সালে তিনি মারা যান এবং তার গবেষণাটি অসমাপ্ত থেকে যায়। পরবর্তীতে, লোয়েল অবজারভেটরির তরুণ গবেষক ক্লাইড টমবাউ ১৯২৯ সালে এই অনুসন্ধানের দায়িত্ব নেন।


কীভাবে প্লুটো আবিষ্কার করা হয়?

টমবাউ একটি বিশেষ ধরণের ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করে নক্ষত্রদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। ১৯৩০ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি, তিনি দুটি ভিন্ন দিনে তোলা ছবি তুলনা করে একটি বস্তুকে দেখতে পান, যা ধীরে ধীরে স্থান পরিবর্তন করছিল। এই পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই প্লুটো গ্রহের অস্তিত্ব নিশ্চিত হয়।

প্লুটো আবিষ্কারের পরপরই এটি সৌরজগতের নবম গ্রহ হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং এর নামকরণ করা হয় রোমান পুরাণের পাতাল দেবতার নামানুসারে।


প্লুটোর বৈশিষ্ট্য

প্লুটো একটি ছোট ও বরফে আচ্ছাদিত গ্রহ। এর গঠন, আবহাওয়া ও কক্ষপথ অন্যান্য গ্রহের তুলনায় বেশ ব্যতিক্রমী। নিচে প্লুটোর কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো:

  • গঠন: প্লুটো মূলত বরফ ও পাথরের সমন্বয়ে গঠিত।
  • ব্যাসার্ধ: প্রায় ১,১৮৮ কিলোমিটার, যা চাঁদের তুলনায় ছোট।
  • কক্ষপথ: প্লুটোর কক্ষপথ অত্যন্ত উপবৃত্তাকার এবং এটি সূর্য থেকে ৪.৬ বিলিয়ন মাইল দূরত্ব পর্যন্ত চলে যেতে পারে।
  • উপগ্রহ: প্লুটোর সবচেয়ে বড় চাঁদ 'চ্যারন' (Charon), যার আকার প্লুটোর প্রায় অর্ধেক। এ ছাড়া হাইড্রা, নিক্স, স্টাইক্স এবং কের্বেরস নামে আরও চারটি উপগ্রহ রয়েছে।
  • একদিনের দৈর্ঘ্য: প্লুটোতে একদিন পৃথিবীর ৬.৪ দিনসমান।

প্লুটোর গ্রহের মর্যাদা হারানো

২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থা (IAU) নতুনভাবে 'গ্রহ' শব্দের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। নতুন সংজ্ঞা অনুসারে, কোনো বস্তুকে গ্রহ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে:

১. এটি সূর্যের চারদিকে কক্ষপথে ঘুরতে হবে। 2. এটি নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণের কারণে গোলাকার হতে হবে। 3. এটি নিজের কক্ষপথ থেকে অন্যান্য বস্তুকে সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হতে হবে।

প্লুটো এই শেষ শর্তটি পূরণ করতে পারেনি, কারণ এটি কুইপার বেল্টের অন্যান্য বস্তুদের সঙ্গে একই কক্ষপথ ভাগ করে নেয়। এ কারণেই ২০০৬ সালে প্লুটোকে 'বামন গ্রহ' (Dwarf Planet) হিসেবে পুনঃশ্রেণীবদ্ধ করা হয়।


নিউ হরাইজনস মিশন ও প্লুটোর নতুন তথ্য

২০১৫ সালে নাসার নিউ হরাইজনস (New Horizons) মহাকাশযান প্রথমবারের মতো প্লুটোর কাছাকাছি পৌঁছায় এবং এটির পৃষ্ঠের বিশদ ছবি পাঠায়। এই মিশন থেকে প্লুটোর আবহাওয়া, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও পৃষ্ঠতলের বিস্তারিত তথ্য জানা যায়।

🔹 প্লুটোর বরফে ঢাকা পর্বত ও উপত্যকা আছে। 🔹 এটি একটি পাতলা নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডল দ্বারা বেষ্টিত। 🔹 প্লুটোর পৃষ্ঠে হিমশীতল গ্লেসিয়ার ও রহস্যময় গঠন রয়েছে।


উপসংহার

প্লুটোর আবিষ্কার মানব সভ্যতার জন্য একটি বড় অর্জন ছিল। যদিও এটি এখন আর সৌরজগতের প্রধান গ্রহের অংশ নয়, তবুও এর রহস্যময়তা ও সৌন্দর্য মহাকাশ গবেষকদের মুগ্ধ করে রেখেছে। প্লুটো আমাদের সৌরজগতের বহির্ভাগের রহস্য উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং ভবিষ্যতে আরও গবেষণার দরজা খুলে দিয়েছে।

১৮ ফেব্রুয়ারি, প্লুটোর আবিষ্কার দিবস স্মরণ করে আমরা মহাকাশ গবেষণার এই অসাধারণ যাত্রাকে সম্মান জানাই। 🚀🌌

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৩