মিজান ও আমলনামার বিচার
মিজান ও আমলনামার বিচার
কিয়ামতের দিন মানুষকে তার কর্মের হিসাব দেওয়া হবে। তখন আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকের আমলনামা তুলে ধরবেন এবং তাদের কর্ম ওজন করার জন্য মিজান (তুলাদণ্ড) স্থাপন করা হবে। এটি হবে এক কঠিন মুহূর্ত, যেখানে কেউ বিন্দুমাত্র জুলুমের শিকার হবে না, বরং প্রত্যেকে তার কর্ম অনুযায়ী প্রতিফল পাবে।
![]() |
মিজান ও আমলনামার বিচার |
আল্লাহ তাআলা বলেন:
"আমরা কিয়ামতের দিনে ন্যায়বিচারের মাপকাঠি স্থাপন করব। অতঃপর কোনো ব্যক্তির প্রতি সামান্যতম জুলুম করা হবে না। যদি এক সরিষা দানা পরিমাণও (কোনো কাজ) হয়, তবে আমি তা উপস্থিত করব। আর হিসাব গ্রহণে আমি যথেষ্ট।"
📖 (সূরা আম্বিয়া: ৪৭)
🔹 মিজান (তুলাদণ্ড) কী?
মিজান অর্থ ওজন করার যন্ত্র বা পরিমাপের মাপকাঠি। কিয়ামতের দিন মানুষের সকল নেক ও বদ আমল মিজানে ওজন করা হবে। যার ভালো কাজের পাল্লা ভারী হবে, সে জান্নাতি হবে, আর যার মন্দ কাজের পাল্লা ভারী হবে, সে জাহান্নামে যাবে।
🔸 রাসুল (সা.) বলেন:
"দুইটি বাক্য রয়েছে, যা মুখে বলা সহজ, কিন্তু মিজানে অত্যন্ত ভারী এবং আল্লাহর কাছে প্রিয়— 'সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আজিম'।"
📖 (সহিহ বুখারি: ৬৬৮২, সহিহ মুসলিম: ২৬৯৪)
🔸 আরেক হাদিসে এসেছে:
"কিয়ামতের দিন বড় বড় দেহবিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত হবে, কিন্তু তাদের ওজন একটি মশার ডানার সমানও হবে না।"
📖 (সহিহ বুখারি: ৪৭২৯, সহিহ মুসলিম: ২৭৮৫)
🔹 আমলনামা কীভাবে দেওয়া হবে?
কিয়ামতের দিন মানুষের জীবনের সমস্ত কাজের বিবরণ লেখা থাকবে আমলনামা নামে একটি বিশেষ নথিতে। প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার আমলনামা দেওয়া হবে, যা নির্ধারণ করবে তার চূড়ান্ত পরিণতি।
📝 তিন ধরনের আমলনামা থাকবে:
1️⃣ যারা ডান হাতে আমলনামা পাবে (সফলতা)
- এরা ঈমানদার ও সৎকর্মশীল ব্যক্তি।
- তাদের জন্য জান্নাত নির্ধারিত হবে।
- আল্লাহ তাআলা বলেন:
"অতঃপর যাকে তার আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে, সে বলবে: 'আহা! আমার আমলনামা পড়ে দেখো! আমি জানতাম, আমার হিসাব নেওয়া হবে!' ফলে সে সুখী জীবনে থাকবে।"
📖 (সূরা হাক্কাহ: ১৯-২১)
2️⃣ যারা বাম হাতে আমলনামা পাবে (ব্যর্থতা)
- এরা পাপী ও অবিশ্বাসী ব্যক্তি।
- তাদের জন্য কঠিন শাস্তি নির্ধারিত হবে।
- আল্লাহ তাআলা বলেন:
"আর যাকে তার আমলনামা বাম হাতে দেওয়া হবে, সে বলবে: 'হায় আফসোস! যদি আমাকে আমার আমলনামা না দেওয়া হতো!'"
📖 (সূরা হাক্কাহ: ২৫-২৬)
3️⃣ যারা পেছন থেকে আমলনামা পাবে (মুনাফিক ও দुष্কৃতকারী)
- এরা আল্লাহর পথে অবাধ্য ছিল এবং তাদের জীবন অন্যায় কাজে ব্যয় করেছে।
- তারা বলবে, "হায়, যদি আমি পুনর্জন্ম পেতাম!" কিন্তু তখন আর কোনো সুযোগ থাকবে না।
🔹 মিজান ও আমলনামার বিচার কীভাবে হবে?
1️⃣ মানুষের প্রতিটি কাজ ওজন করা হবে:
- নেক আমল ও মন্দ আমল তুলাদণ্ডে ওজন করা হবে।
- অতি ছোট কাজও গোপন থাকবে না।
2️⃣ কোনো অবিচার হবে না:
- মানুষ তার কর্ম অনুযায়ী প্রতিদান পাবে।
- কেউ সামান্যতম অন্যায় করলেও তার হিসাব দিতে হবে।
3️⃣ কিছু আমল মিজানে সবচেয়ে ভারী হবে:
- তাওহিদ (আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস)।
- আখলাক বা উত্তম চরিত্র।
- নিয়মিত নামাজ, রোজা ও জিকির।
🔸 রাসুল (সা.) বলেন:
"মুমিনের মিজানে সবচেয়ে ভারী বস্তু হবে তার সুন্দর আচরণ।"
📖 (সহিহ তিরমিজি: ২০০২)
🔹 মিজান ভারী করার ৫টি উপায়
✅ ১. সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করা (জিকির করা)
- "সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি" বললে মিজান ভারী হয়।
✅ ২. নিয়মিত নামাজ আদায় করা
- নামাজ সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত, যা মিজানে ভারী হবে।
✅ ৩. ভালো চরিত্র ও সদাচার চর্চা করা
- মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার ও বিনয়ী আচরণ করুন।
✅ ৪. কুরআন তিলাওয়াত ও আমল করা
- "আল-কুরআন সুপারিশ করবে এবং তা মিজানে ওজন করা হবে।"
✅ ৫. দান-সদকা করা
- "সদকা কিয়ামতের দিনে ছায়া হয়ে দাঁড়াবে।" (তিরমিজি: ৬০৪)
🔹 উপসংহার
কিয়ামতের দিন মিজান (তুলাদণ্ড) ও আমলনামা মানুষের জীবনের প্রতিটি কাজের চূড়ান্ত মূল্যায়ন করবে। এই বিচার থেকে কেউ রেহাই পাবে না। সুতরাং আমাদের উচিত, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর আনুগত্য করা, সৎ কাজ করা এবং পাপ থেকে বিরত থাকা, যাতে আমাদের আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হয় এবং মিজানে নেক আমল ভারী হয়।
🔸 আল্লাহ আমাদের সবাইকে কিয়ামতের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের আমলনামা ডান হাতে দিন। আমিন! 🤲